কী কারণে ভিন্নপথে ডিপিডিসি?
স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় :
০৬-০৫-২০২৫ ০৯:০৭:৪৮ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৬-০৫-২০২৫ ০৯:০৭:৪৮ অপরাহ্ন
গ্রাফিক্স : বাংলা স্কুপ
আমিনুল কবীর সুমন॥
শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রায় সব বিতরণী সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রণীত নীতিমালা মানলেও ঢাকার একটি সংস্থার বিরুদ্ধে উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। সংস্থাটি বছর পাঁচেক আগে একটি অফিস আদেশ জারি করে সেই মোতাবেকই শিল্পকারখানায় সংযোগ দিয়ে যাচ্ছে। আর এই সুযোগে কিছু অসাধু কমকর্তা নিজেদের পকেটে ভারি করে চলেছেন।
বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণী সংস্থা ১০০০ কিলোওয়াটের মধ্যে এক্সপ্রেস ফিডার (ডেডিকেটেড) ছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে থাকে। আর ১০০০ কিলোওয়াট তদুর্ধ্ব সংযোগগুলো দেয়া হয় এক্সপ্রেস ফিডারের মাধ্যমে। কিন্তু ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) হাঁটছে ভিন্নপথে। সংস্থাটি শিল্পসংযোগের ক্ষেত্রে ১৫০০ কিলোওয়াটের উপরে হলে এক্সপ্রেস ফিডারের (ডেডিকেটেড) মাধ্যমে সংযোগ দিচ্ছে। আর এক্সপ্রেস ফিডার ছাড়া সংযোগ দেয়া হচ্ছে ১৫০০ কিলোওয়াটের নিচের আবেদনগুলোতে। এতে করে একই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিতরণী সংস্থাগুলো চলছে দুই রকমের নীতিতে। উপরন্তু, বিতরণী লাইনের উপর পড়ছে বাড়তি চাপ। বিগত স্বৈরাচার সরকারের প্রতিমন্ত্রী ও তাঁদের দোসররা আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে বিভ্রান্তিকর অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে।
রাজধানী ও আশপাশের এলাকার অধিকাংশ স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে ডিপিডিসি ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। বাংলাস্কুপের হাতে আসা নথি থেকে জানা যায়, ডিপিডিসি ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বরে বিদ্যুৎসংযোগের নীতিমালা সংশোধন করে একটি অফিস আদেশ জারি করে। সেই আদেশে দেখা যায়, এক্সপ্রেস ফিডারের (ডেডিকেটেড) ১৫০০ কিলোওয়াটের উপরে বিদ্যুৎ সংযোগগুলো ডিপোজিটের আওতায় গ্রাহককে টাকা পরিশোধ করে সংযোগ নিতে হবে। এই আদেশ জারির আগে ১০০০ কিলোওয়াটের তদুর্ধ্ব সংযোগগুলো এক্সপ্রেস ফিডারের আওতায় সংযোগ দিতে হত। অর্থ্যাৎ গ্রাহককে সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ বিতরণী কোম্পানির সঞ্চালন লাইন (আন্ডারগ্রাউন্ড অথবা ওভারহেড) নির্মাণের অর্থ পরিশোধ করে সংযোগ নিতে হত। প্রশ্ন উঠেছে, কার নির্দেশে নীতিমালায় এই পরিবর্তন আনা হয়েছিল।
অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েই ডিপিডিসির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ানকে দিয়ে এই অফিস আদেশ জারি করান। ডিপিডিসির প্রকৌশলীরা বলছেন, আমাদের বিদ্যুৎ বিতরণী লাইনগুলো এমনিতেই জরাজীর্ণ। তার ওপর এই সংযোগগুলো দিতে গিয়ে বিভিন্ন সময় সঞ্চালন লাইনে ত্রুটি দেখা দেয়। লাইনগুলোর উপর পড়ছে বাড়তি চাপ। এতে বিতরণী লাইন প্রায়ই ট্রিপ করছে। যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা খরচ করে বিদ্যুৎলাইন নির্মাণ করলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। একটি শিল্পকারখানা স্থাপন করতে গেলে সর্বনিম্ন ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। ওই শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতে ডেডিকেটেড (সঞ্চালন) লাইন নির্মাণে যে টাকা খরচ হয় তা পুরো বিনিয়োগের তুলনায় কিছুই নয়। শিল্পকারখানাটি ১১ বা ৩৩ কেভিএ লাইন থেকে যদি বেশি দূরেও হয়, তাহলে রোড কাটিংয়ের খরচসহ দুই থেকে তিন কোটি টাকার বেশি লাগার কথা নয়। আবাসিক ও বাণিজ্যিক সংযোগগুলো উচ্চচাপ (৮০ তদুর্ধ্ব থেকে ৮০০ কিলোওয়াট) গ্রাহকরা স্থাপনার পাশে এসটি লাইন না থাকলেও ডিপোজিটের টাকা পরিশোধ করেই লাইন নির্মাণ করে সংযোগ নেয়। সেখানে শিল্পকারখানা তো বিশাল বিষয়। আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের চেয়ে শিল্পমালিকদের বেশি সুবিধা দেওয়ার কারণ কী? কার নির্দেশে তখন ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ অফিস আদেশ জারি করেছিল- এখন তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার সময় এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, ডিপিডিসির সংশোধিত নীতিমালা অনুসরণ করে সংযোগ দিতে গিয়ে সরকারের বিতরণী লাইনের উপর চাপ বেশি পড়ছে। এই নীতিমালা দ্রুত সংশোধন করা খুবই জরুরি।
রাজধানীর আরেক বিতরণী সংস্থা ডেসকোর নির্বাহী পরিচালক অপারেশন (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রকৌশলী জুলফিকার তাহমিদ এ বিষয়ে বলেন, আমরা ১০০০ কিলোওয়াটের উর্ধ্বে সংযোগগুলো লাইন নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক মালামাল বাবদ ডিপোজিটের সামান্য টাকা নিয়েই সংযোগ দিয়ে থাকি। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এর ব্যত্যয় ঘটে। গ্রাহকের স্থাপনার পাশেই যদি আমাদের বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থাকে সেখান থেকে আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলের মাধ্যমে অল্প খরচেই সংযোগ দিয়ে থাকি। মোট কথা, ডেসকো গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে অল্প খরচেই সেবা দিয়ে থাকে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রণীত নীতিমালা মেনেই বিতরণী কোম্পানিগুলো চলছে। সারাদেশে বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণী কোম্পানিগুলোর বাস্তবতা ভিন্ন। রাজধানী বা মহানগরগুলোতে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের অবকাঠামো এক রকম, আর মফস্বল বা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর অবস্থা অন্য রকম। তাই কোনো বিতরণী কোম্পানি চাইলেই নিজস্ব নিয়মে চলতে পারে না। এর জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের নির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে।
নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই (নেসকো) উত্তর জনপদে শহর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলায় কোম্পানিটি বিদ্যুৎসেবা দিয়ে আসছে। নেসকোর প্রকৌশলীরা বলছেন, ১০০০ কিলোওয়াটের উর্ধ্বে সংযোগগুলো আমরা গ্রাহকের কাছ থেকে নামমাত্র ডিপোজিটের টাকা নিয়ে সংযোগ দিচ্ছি। তবে ১১কেভিএ লাইন যদি গ্রাহকের স্থাপনার পাশেই থাকে, তাহলে নামমাত্র লাইন নির্মাণের খরচ নেয়া হয়।
ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) খুলনা, বরিশাল ও বৃহত্তর ফরিদপুর বিভাগের ২১টি জেলা ও ২০টি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছে। ওজোপাডিকোর প্রকৌশলীরা বলছেন, বিইআরসি প্রণীত নীতিমালা অনুসরণ করে ১০০০ কিলোওয়াট তদুর্ধ্ব সংযোগগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে নামমাত্র ডিপোজিটের টাকা নিয়ে সংযোগ দিয়ে থাকি।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) প্রকৌশলীরা জানান, সর্বনিম্ন ৫ মেগাওয়াট অর্থ্যাৎ ৫০০০ কিলোওয়াটের সংযোগগুলো ১১ কেভিএ অথবা ৩৩ কেভিএ লাইন থেকে দিতে গিয়ে যদি স্থাপনার পাশে হয়ে থাকে সেক্ষেত্র আমরা ক্যাবল ও ব্রেকারের মূল্য গ্রাহকের কাছ থেকে নিয়ে থাকি।
এ বিষয়ে বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বাংলা স্কুপকে বলেন, শিল্পক্ষেত্রে সংযোগের বেলায় দ্বৈত নিয়ম রাখার কোনো সুযোগ নেই। সংযোগের ক্ষেত্রে ডিপিডিসির নিজস্ব নীতিমালা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিইআরসি সংযোগের নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আবাসিক বা শিল্প, যে সংযোগই হোক না কেন,বিদ্যুৎ বিতরণী সংস্থাগুলো একটি নীতিমালাই অনুসরণ করবে। সেই সাথে রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের গাইডলাইন।
ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলাম বলেন, ডিপিডিসির বিদ্যুৎ সংযোগ নীতিমালায় সর্বশেষ যে সংশোধন হয়েছে, তখন আমি এখানে ছিলাম না। মূলত: এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মতামত নিয়ে লোড ম্যানেজমেন্ট হয়ে থাকে। তৎকালীন কর্তৃপক্ষ কী করেছে বা কেন করেছে, তা আমার জানা নেই।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজ বাংলা স্কুপকে বলেন, একটি নিয়মের মধ্যেই সব বিদ্যুৎ বিতরণী সংস্থাকে কাজ করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মহোদয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি রাষ্ট্রের অর্থ সাশ্রয় ও গ্রাহকের নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এমতাবস্থায় কোনো বিতরণী সংস্থার এ জাতীয় ভ্রান্তনীতি সরকারের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
তিনি আরো বলেন, ডিপিডিসির সংযোগ নীতিমালা কেন সংশোধন হয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বাংলা স্কুপকে বলেন, বিইআরসি ও বিদ্যুৎ বিভাগের সংযোগ নীতিমালা অনুসরণ করেই সব বিতরণী সংস্থাকে চলতে হবে। এখানে নিয়মের ব্যত্যয় করার কোনো সুযোগ নেই।
সংযোগের ক্ষেত্রে বিগত সরকারের সময় ডিপিডিসির করা নিজস্ব নিয়মের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, কাউকে বাড়তি সুবিধা দেয়ার এখতিয়ার ডিপিডিসির নেই। এই বিষয়টি সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল নই। এখন বিষয়টি খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিগত সরকার উন্নয়নের ধুয়া তুলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এ খাত এখন ঋণে জর্জরিত। আমরা সেখান থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করে অর্থ সাশ্রয় করেছি। এমন অবস্থায় কোনো রকমের অনিয়ম ও রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় বরদাশত করা হবে না।
বাংলা স্কুপ/প্রতিবেদক/শাহরিয়ার খান/এসকে
(দ্বিতীয় পর্বে থাকছে শিল্পকারখানায় বিদ্যুৎ সংযোগের অনিয়মের বিস্তারিত)
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স